সরদার আজিজুর রহমান : বাসে উঠলাম, সিলেট যাবো। সব সিটেই মানুষ বসা। কয়েকজন দাঁড়িয়েও আছে। বাসের মাঝামাঝি দুই সিটের একটা বেঞ্চে একটি মেয়ে বসে আছে। পরিপাটি বেশ দামী মার্জিত পোশাক, বয়সে ত্রিশ কি বত্রিশ হবে তার বেশি নয়। তার পোশাক এবং চেহারায় আভিজাত্যের ভাব থাকায় যারা দাঁড়িয়ে আছেন তারা কেউই বসতে চাচ্ছে না। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি- এক মিনিটের মধ্যে ঐ মেয়েটা দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে করে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
চাচাজান আসেন আমার পাশে বসেন। আমি যেয়ে বসলাম- মেয়েটা পরে বসলো। জিজ্ঞাসা করলো- কোথায় যাবেন? আমার স্বভাব মতো বললাম- কেন? পাখির পাখা যতোদূর যেতে পারে। তুমি? বুদ্ধিমান মেয়েটা বললো- আমিও।
তার পর বললো- আমি আপনার ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করি? পুরা শুদ্ধ ভাষা এবং মার্জিত ভঙ্গি।- আমি বললাম- তুমি থাকো কোথায়? মেয়েটা বললো আমার আব্বার বাড়ি এবং শশুর বাড়ি দুটোই কুলাউড়ায়। গত চার বছর ধরে থাকছি সিলেট শহরে। ওখানে একটা হাইস্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করি। আমার স্বামী একটা বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আমাদের একটা ছেলে ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। এবার আপনার কথা শুনি।
আমার কথা শুনবে?- আমি একদিন গাছ থেকে পড়লাম। ঐ গাছেরই ফল খেয়ে এডালে ওডালে ঘুরে ঘুরে এখন কবরে যাবার অপেক্ষায় আছি। মেয়েটা বললো, আপনি কবিতার মতো করে বললেন। আমি আপনার সঠিক পরিচয় জানতে চাই। আপনি কি সার কারখানায় চাকরি করতেন? আমি বললাম- তোমাকে আমার রাজ্যে গুপ্তচর মনে হচ্ছে। তাই আমার আসল পরিচয় তোমাকে জানাবো না।
-আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার অচেনার মাঝে চেনা একজন। আমার অন্তরে আপনি লুকিয়ে থাকবেন তা পারবেন না। আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে ধরে ফেলেছি। আমার আম্মা তাঁর একান্ত বন্ধু বলে মনে করেন আমাকে। আমি যখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্স-এ গেলাম তখন থেকেই তার অন্তরের পাথরগুলো গলতে শুরু করলো- আর সেটা স্রোত ধারা আমার অন্তরে এসে মহাসাগর হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে সেই সাগরে নাও ভাসিয়ে দিক হারিয়ে ফেলি। আমার এই নাও এর বৈঠায় আপনার নাম লেখা আছে। আর নৌকার পালে আপনার ছবি বাতাসে দুলতে থাকে। আমার কাছ থেকে শুনে শুনে আপনার ছবি- প্রকৃতি আমার হৃদয়ে গেথে আছে। আপনি খুব ভালো মানুষ। আমার আম্মার শত সুখ ঐশ্বর্যের মাঝে আপনার কথা কখনোই ভোলেন না। আর একমাত্র আমিই তা জানি। আমার নানা-নানি মারা গেছেন। বড় মামা আপনাকে খুব অত্যাচার করেছেন। আম্মা যখন এই কথা মনে করেন তখনি একটু কাঁদেন অল্প সময় শেষ যেন বুঝতে না পারে। আমি বুঝি। আব্বা কুলাউড়ায় বাড়ি করেছেন। ওখানেই দুজনে থাকেন। আর একটা কাজের মেয়ে আছে। আব্বা রিটার্ড করেছেন পাঁচ বছর আগে, তখনি এই বাড়িটা করেন। মাঝে মাঝে আব্বা গ্রামের বাড়িতে যান, তখন আম্মা যান না। আবার আম্মা যখন নানা বাড়ি যান আব্বা তখন যান না। সাধারণত ঐ সময় আম্মা আমাকে কুলাউড়ায় বাড়িতে আসতে বলেন। আমিও আসি। আর তখনই আমাদের দুই বন্ধুর কথা হয় সারারাত আকাশের নিচে বাড়ির ছাদে বসে। তার সবটুকুই আম্মার বুকের ঐ পথ চলা স্রোতধারা।
আম্মার কস্ট আমি বুঝি- অন্য কেউ তা বোঝে না। আম্মা আপনাকে খুব বেশি ভালোবাসে। আপনার পোশাক, চলা-বলা, ভাব-ভঙ্গি। আম্মার অন্তরে গেঁথে নিয়েছেন।
আম্মা আপনার সব কথা আমাকে এতো বলেছেন যে আমার অন্তরেও আপনার ছবিটা খুব পরিষ্কার। আমি আপনাকে খুব ছোটবেলা দেখেছি। শেষ দেখা হয় আমি তখন ক্লাস টুতে পড়ি অর্থাৎ সাত-আট বছর বয়সে। তারপর আম্মা আর এদিকে আসেননি। আমাদের আত্মীয়-স্বজন চার-পাঁচটা পরিবার এখানে অনেক দিন ছিলো। শুনেছি এখনো একজন আছে। আম্মা মনে করেন তাদের কথা- তারা গ্রামে গেলে কথা হয়। তারা এখানে আসতে বলে। আম্মা দুর্বলভাবে বলেন। হয়তো আর কোনদিন ওখানে যাওয়া হবে না। এখন তো মোবাইল ফোন, মনের কথা বলার সহজ সুযোগ করে দিয়েছে। আমি আম্মাকে বলেছি। আম্মা বলেন আমি একটু চেষ্টা করলে মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করতে পারবো, কিন্তু কি বলবো- বলবার তো আর কিছুই নাই। শুধু মনে হয়, সামনের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হেঁটে যেতো স্মার্ট সৈনিকের মতো জুতার শব্দ তরঙ্গ তুলে লাঠির মতো ছাতাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে- আর আমি জানালা দিয়ে দেখতাম। মনপুর চা বাগানে ভোর বেলায় হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানো, ছড়ার পানিতে পা দুলিয়ে পানি ছিটানোর খেলা করা। কতো স্বপ্ন কথা বলা- তেমন আর কোনদিন হবে না। তোমাদের বুকে করে এ পাথর যতোই গলুক ভার একটুও কমবে না।
আম্মা বলেছেন- ছোট ছোট চিরকুট লিখতেন আপনার কাছে, আমার ছোট খালা অথবা আম্মার বান্ধবীর ছোট ভাইকে দিয়ে আপনার কাছে পাঠাতেন আপনি কোন দিন লিখতেন না- আম্মা মন খারাপ বা রাগ করতেন না। আম্মা বুঝতেন আপনার মনের কথা। আপনি আমার বড় মামা এবং নানা ভাইকে খুব ভয় করতেন। আর সে জন্যই হয়তো আমার নানি বুঝি আম্মাকে সব সময় এ ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। আমার- নানিবুজিও আপনাকে খুব পছন্দ করতেন। আপনি যখন একা বাসা নিলেন জাপানি টিলায় ব্যাচেলর রুমে আমার নানিবুজি দুধের নানান রকম খাবার নিজে তৈরি করে গোপনে আপনার বাসায় নিয়ে আসতেন। আপনার বাসার সামনে একটা খোলা মাঠ ছিলো। মাঠের মাঝখানে পাশা-পাশি দুটো আম গাছ ছিলো। আমার নানিবুজি ঐ আম গাছের নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আম্মা খাবার নিয়ে আপনার ঘরে আসতেন। সাধারণত সন্ধার পর পরই অথবা রাত দশটার পরে হলেও রোজ একবার আসতেন। আপনি দরজা জানালা খুলে রাখতেন। আম্মা আসলেও আপনি বন্ধ করতেন না। আম্মা বন্ধ করতে চাইলে আপনি মানা করতেন। এতোদূর এগুবার সময় হয় নাই। এখানে সমাজের মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে। আমি অনেক সামাজিক কাজ করি, অনেক মেয়েদের সাথে মিশি কেউ আমাকে সন্দেহ করতে পারে না। এখানে আসে পাশে বাসা আছে। সবাই স্ত্রী নিয়ে থাকে। আমিই শুধু একা। আমার প্রতি সবার নজর আছে। এর মধ্যে অনেকেই বুঝে ফেলেছে- কিন্তু আমাকে সবাই বিশ্বাস করে দেখা যাক আল্লাহর যদি ইচ্ছা থাকে….। সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তেমার আব্বা, তোমার বড় ভাই আমার উপর খুব রেগে আছে তুমি জানো- ধরবার সুযোগ সুবিধা করতে পারছে না। আমি একটু লেখাপড়া জানি। লেখাপড়া জানা ভালো মানুষের সাথে মিশি। ভালো চাকরি করি ভয় কি তোমার। পরিবার সমাজ নিয়েই তো চলতে হবে- ধৈর্য ধরো। তোমার আম্মাকে দোয়া করতে বোলো। আমি তোমাদের সবাইকে ভালো মনে করি। তোমার আব্বা তোমার বড় ভাই যা করছেন আমি তাতে কষ্ট বোধ করি না। এটাই স্বাভাবিক, ওনাদের মধ্যে কোন ভুল কাজ করছে। তুমি ঠিক থাকলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো আছি। আমাকে ভয় করো না। তোমাকে ভালোবাসি, আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো। আমি তোমাকে কষ্ট দেবো না।
আম্মা বলেন, বিশ্বাস আমার আছে। আমার একার উপরই তো সব নির্ভর করে না। আম্মার জন্যই তো এতোদিন টিকে আছি। কখন কি হয়ে যায়- আমার মাথাটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়।
এই রকম দিন দিন হাজার দিন হাজার রাত পার হয়ে যায়। একদিন রাত আটটার কিছু পরে আম্মা আপনার রুমে এলেন। নানিবুজি সেই আম গাছ তলায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক কথা হলো,- একসময় আপনার গলা জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকলেন বার বার একটা কিছু করো মৃত্যু আমার দিকে ধেয়ে আসছে- একমাত্র তুমিই পারো আমাকে রক্ষা করতে। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না…।
জানালা-দরজা আমাদের খোলা, লাইট জ্বলছে। আম্মার চোখে দুনিয়ার ঘন অন্ধকারের মাঝে আপনার চোখ দুটো ধ্রুব তারার মতো জ্বলছে। সে কখনো দিক পরিবর্তন করে না। ঘড়ির হিসাবে ষাট মিনিটের বেশি হয়েছিলো- মনের হিসাবে এক ফোটা সময় আপনি কিছুই বলেন নাই। আম্মা আপনার গলা ছেড়ে দিয়ে অসহায় ফাঁসির আসামির মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন- আম্মা আর নানিবুজি দুজনই বরণ হয়ে গেলো- মহাকালের অন্ধকারে। আর দেখা হয় নাই।
তবে তিন দিন পর অর্থাৎ চতুর্থ দিন সকালে খুব ভোরে আম্মার বান্ধবির ছোট ভাই একখানা চিরকুট দিয়ে গেল আপনাকে।- তাতে লেখা ছিলো এরকম যে আর হয়তো দেখা হবে না; নতুন কোন কথা হবে না- পুরনো সব কথা জ্বালিয়ে দিও। আমি জানি তুমি কেমন থাকবে। আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না।- আর পারছি না। ইতি- আমি তোমার নই।’
আমি বললাম- তারপর কি হলো জানো।
এবার আমার কথা শোন- এর দুইদিন পর ঐ রকম ভোর বেলায় সেই ছেলেটা সেই রকম ছোট্ট একটা চিরকুট দিয়ে গেলো। তাতে শুধু লেখা- আজ রাত্রে ঠিক সাড়ে আটটায় আমাদের বাসায় আসবেন, আমি অনুরোধ করছি।- ইতি। আপনার আপনজনের বান্ধবী। আমি তাকে চিনতাম এবং জানতাম আগে থেকেই।
গতকাল অফিসে যাই নাই, আজও গেলাম না। কেমন যে হাহাকার লাগছে বুকটার ভেতর। কিছুই খেতে পারছি না। নিজে রান্না করে খাই। দুই দিন আগে যে রান্না করেছিলাম তাই পচে সারা ঘরে গন্ধ হয়ে গেছে। এটা যে ফেলেদিতে হবে এই বোধটাও আমার ছিলো না। এই চিরকুটটা পেয়ে বুকের মরুভূমিতে যেন এক ফোটা পানি পড়লো।- কখন রাত সাড়ে আটটা বাজবে। আমার এখান থেকে দশ-বারো মিনিটের পথ। আমি তখন হাতে ঘড়ি পরতাম- ফেবারলুবা খুব দামী ঘড়ি। ঘড়িটা যেন চলছে না। পত্রিকা বই পড়া কিছুই ভালো লাগছে না। ক্ষুধা অনুভব হয় না। এই তিন দিন শুধু মাঝে মাঝে বিস্কুট, চানাচুর আর পানি খেয়েছি। মচমচা বিস্কুট, চানাচুর চিবলে ব্রেনের মধ্যে একটু ভালো লাগে। চিন্তার শক্তি বাড়ে।
দশ মিনিট আগে রওনা হলাম। নভেম্বর মাসে শেষ সময়। জানালা দরজা বন্ধ। কড়া নেড়ে ওর ছোট ভাইয়ের নাম ধরে ডাক দিলাম। মুহূর্তে দরজা খুলে গেলো। তোমার আম্মার বান্ধবী আমাকে বসতে বলে। দরজা বন্ধ করে দিলো।- বসেন আমি আসছি ভিতরের রুমে গেল। আমি সোফা চেয়ারে বসলাম। আমি একসময় বাসায় বাসায় খেয়ে টিউশনি করতাম তাই অনেক ছেলে মেয়ে আমাকে স্যার বলে। তোমার আম্মার বান্ধবী ট্রেতে করে কিছু পিঠা-পায়েশ আর আমার পছন্দের চানাচুর নিয়ে এলো। বললো, স্যার খেয়ে নিন। তার পরে আমি কিছু কথা বলবো।
-আমি বললাম। না, আগে কথা শুনি পরে খাবো। কয়েকবার বললো- আমি খেলাম না। আমি খুব করুন ভাবে বললাম- কি কথা বলো। আমার কষ্ট হচ্ছে, চলে যাবো। সবই তোমার জানা, আমি কেমন আছি তুমি অনুভব করতে পারো।
তুমি জানো আজ কয়দিন থেকে ওকে দেখি না, ওর কথা শুনি না। আমার চোখ-কান অন্ধ-বধির হয়ে যাচ্ছে। কোথায় আছি জানি না।
তোমার আম্মার বান্ধবী। আমার সামনের সোফায় বসে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। যেন কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।
আমি এবার তার মুখের দিকে চাই আর খাবারের দিকে চাই, মনে মনে ভাবি এ পিঠা পায়েশ কিসের জন্য। কি উপলক্ষে। মনে হলো বুকের মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পিঠাচ্ছে। আমি বাঁকা হয়ে যাচ্ছিলাম। মেয়েটা কিছুই বলে না। কতো সময় যেন চলে গেল,- আমি নিজের মাথা- কপালে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে- দাঁড়ালাম। বললাম- আমি আসি, আমার কষ্ট হচ্ছে।
মেয়েটা দাঁড়িয়ে, হাত দিয়ে বাধা দিয়ে একটু জোর দিয়ে বললো- কোথায় থেকে গেলো যেন এই অধিকার- একটু বসেন স্যার। এর পরই পাশের রুম থেকে আসলো তোমার আম্মা। লাল শাড়িতে লাল টগরের ছাপা দেওয়া ফুলে সাজানো শরীর, খোলা লম্বা চুল সামনের দিকে মেলে দেওয়া। ঐ লালের আলো। কালো চুলের অন্ধকারে আমার অন্তরের অন্ধকার মিলে গেলো। আমি একবার শুধু চাইলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম- দরজা খুলে বেরিয়ে আসবো। তোমার আম্মা বললো,- আমাকে অভিশাপ দিও। আমার কাছে মনে হলো কাঁন্দতে ছিলো। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।
তার পরে আর দেখা হয় নাই। তোমার আম্মার বান্ধবী আমাকে একদিন বলেছে শেষ যে দিন আমার রুম থেকে বেরিয়ে যায়, ঐ রাতের বারোটার পরে মাত্র ছয়-সাতজন মানুষ আর মসজিদের ইমাম- কাজী সাহেবকে ডেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পাশের বাসারও কেউ জানতে পারে নাই।- তার আর পর নাই।
-তার পরও আছে। বলেন, আমি জানি। আমি শুনছি।
-এই ঘটনার ছয় বছর পরে একবার এসেছিলো তোমার নানিবুজিকে নিয়ে। হয়তো আমাকে দেখার জন্য, কিন্তু ভাগ্য তেমন ছিলো না। আমি অফিসে ছিলাম। বেলা দুটোয় আমার ছুটি হয়।
বাসায় এসে জানলাম। ততোদিনে আমি বিয়ে করেছি। আমার প্রথম সন্তান ছেলের বয়স প্রায় চার বছর আর দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে বয়স মাত্র পাঁচ মাস হয়েছে। আমি তখন অন্য একটা বড় বাসায় থাকি। প্রায় তিন ঘন্টা ছিলো। আমার স্ত্রী আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে অনেক কথা হয়েছে খেলা হয়েছে। সংক্ষেপে তা ছিলো খুবই ভালো- খুবই আন্তরিক। আমার আসা পর্যন্ত থাকতে পারে নাই।
আর কোনো কথা জানি না। তবে ঐ বান্ধবীর কাছে শুনেছি তোমরা মাত্র দুই বোন। আমি কখনো জিজ্ঞেস করতাম না। পথে পথে দেখা হলে সে নিজেই বলতো।
আমার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করবেন না?- আমার নাম সাহেদা বেগম, আমার ছোট বোনের নাম সাহানা বেগম। আম্বরখানা পয়েন্টের কাছে ভাড়া বাসায় থাকি। যদি আমার বাসায় একদিন আসেন আমার ছেলের সঙ্গে একদিন খেলা করার দৃশ্যটা আমি ধারন করে রাখতে পারি খুব ভালো লাগবে। এখন কোথায় যাবেন?
-তোমার বাসায় হয়তো আমি কোন দিনই যাবো না। আমার অন্তরে যে পাথর হৃদয়ের আগুনে জ্বলে জ্বলে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে অভাব হয়ে আছে সেখানে আঘাত করলে যে কালো নির্যাস বেরোবে সেটা বড় বিষাক্ত, যার সামান্যতে মৃত্যু হয়।
তোমার বাসায় আমি কোনদিনই যাবো না। কারণ আমি মনে করি তোমার আম্মার সাথে দেখা না হওয়াই ভালো। একেবারে শেষ তোমার আম্মার যে ছবিটা দেখেছি আমার অন্তরে অন্তরের অন্ধকার আকাশে সেই ছবিটা ছোট একটা তারা হয়ে আছে, ঐ তারাটা আমার অন্তরে আলোর উৎস। ওটা অমনি থাক। সেখানে সময়ের পরিবর্তন আমি দেখতে চাই না। তোমার ছেলের সাথে খেলা করার আনন্দ আমার জীবনে কোনদিন আসবে না। মোবাইল নম্বর চেয়েছো- আমার বিবেচনায় ঠিক হবে না। তুমি তোমার আম্মার মতোই সহজ সরল মেয়ে। তোমার ভালো হোক- তোমাদের ভালো হোক। সব সময় দোয়া করবো।
এখন যাবো আমার ছেলের বাসায়। ওর একটা মেয়ে, ছয় বছর বয়স ক্লাস টুতে পড়ে, ওর জন্যই মাঝে মাঝে টাউনে আসি। ছেলেটা কম্পিউটার ইঞ্জিনয়ার ব্যবসা করে। কম্পিউটার সেলস সার্ভিস এবং ট্রেনিং সেন্টার আছে- চলে যাচ্ছে দিন। চারটে মেয়ে প্রথমটা গ্রাজুয়েট হতেই বিয়ে দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়টা ইকোনমিক্স অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে এখন ঢাকায় একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে শিক্ষক। ছোট দুটো অনার্স পড়ছে। পথে যেখান থেকে বাসে উঠলাম ওর কাছেই একটা ছোট্ট বাড়ি করেছি। আমরা দুজন থাকি। বারো ডিসিমেল জায়গায় অনেক ফলের গাছ লাগিয়েছি, সারা বছর কোন না কোন ফল থাকে। আর এই সব গাছে সারা বছর থাকে নানান রকম পাখি- উড়ে যায়- উড়ে আসে। আমি বারান্দায় বসে চেয়ে থাকি, ওরা কতো সুখে আছে। আর আমার হৃদয় পাখি বন্দি করে রাখি উড়তে দেইনা তাকে। রাত্রে আসে শিয়াল, দল বেধে আসে নানান সুরে ডাকে। মিশে থাকে সারা জীবন। ঘটে না কারো সাথে অবিশ্বাসের কোন কারণ। কতো স্বার্থক ওদের জীবন।
-আপনার সাথে দেখা হলো- কথা হলো। আমার জীবনের একটা দুরাশা আজ বাস্তবে ঘটে গেলো, আমি খুবই খুশী। আম্মা শুনলে খুশি হবেন। তবে একটু কষ্ট থেকে গেলো আপনাকে পেয়ে হারালাম। মোবাইল নম্বর দিচ্ছেন না- নিচ্ছেন না। আম্মা আমাকে খুশির মাঝেও বকা দিবেন। আমার প্রতি কি একটু দয়া করা যায় না।
মা গো আমার জীবনের একটা বড় পাওয়া, তোমার সাথে দেখা হলো। কথা হলো, বহুদিন আটত্রিশ বছর পরে তোমার আম্মার কথা জানলাম। আমি যে বেচে আছি তা জানালাম এই তো ভালো। মা-গো, তুমি তো বুঝতেই পারো। জীবন এখন শেষ প্রহরে। সব অন্ধকার দূর হয়ে যাক- সত্যের স্নিগ্ধ আলোয়। ওপারের তরী যেন ভাসাতে পারি পবিত্র আত্মা নিয়ে মহাশূন্যের পথে। এই শুধু প্রার্থনা এখন।
আমরা সিলেট টাউনে এসে গেছি। আর হয়তো দেখা হবে না, দোয়া করো।
তোমার আম্মাকে বলবে, এখন যে সময় হৃদয়ের কষ্ট কাঁটাগুলো কাফন পাপড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা ভালো। আসি মা।